লালসালু ২০১৫

কি যন্ত্রণারে বাবা! বাসা থেকে নামতেই লালসালু ওয়ালাদের কবলে পড়তে হচ্ছে এক সপ্তাহ ধরে!
বাসার গেট থেকে কয়েকগজ দক্ষিণে রাস্তায় যে আইল্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আমি রিক্সা নেই ওখানে আইল্যান্ডের ওপরে গজিয়ে উঠেছে একটা লাল কাপড়ের ঘর- জরি আর গাঁদা ফুলে সাজানো । ঠিক যে ধরনের সুতি লাল কাপড়কেই লাল সালু বলা হতো এক সময়।
ওই ঘরের পাশে, লম্বা জুব্বা, টুপি পরা লাল চোখা একজন দাড়িওয়ালা লোক টুল পেতে বসে হাই ভল্যুমে মরমী গান বাজাচ্ছে। বড় একটা সাউন্ড বক্স রয়েছে সাথে। রিক্সার জন্য আইল্যান্ডের কোণাটায় দাঁড়াতেই প্রতিদিন হাত পেতে দেয় সামনে।
’আপা খাজাবাবার ওরসে দু’দশ টাকা যা পারেন দান কইরা যান, আপনার মকসুদ পুরা হইব।
পুরনো রাবারের স্যান্ডেল পরা ময়লা পা; হাতও তেমনি। আর চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় খাজাবাবার সেবার চাইতে উনি গাঁজাবাবার সেবাই বেশি করেন।
প্রতিদিনই আমি তার হাত পাতার সাথে সাথে বিরক্তিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি দিয়ে দেই দশটা টাকা। একবার পেলে আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু আমার বিবেক তখন কঠোর শাসনদন্ড হাতে তুলে নেয়, বলে: ‘তুমি কেমন ক’রে এখানে টাকা দিতে পার? যখন জান এরা ঠিক করছেন না। এরা পরিষ্কার শির্কে লিপ্ত। তুমি কি তোমার রাসূলের ওরস কর? না তা বৈধ?’
গত সাতদিন তাই বারবার ভেবেও আমি ওদের লালসালুর ঘরের ভেতর টাকা ফেলতে পারিনি। পাশেই একটা হাসপাতাল। অথচ এরা হাই ভল্যুমে গান বাজাচ্ছে। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ কোন রিক্স না পেয়ে বেকার দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম লোকটাকে কিছু বলি।
– এই যে ভাই, এখানে যে একটা হাসপাতাল আছে আর আপনি এভাবে যে জোরে গান বাজাচ্ছেন কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
– আর তো দুইডা দিন আফা। খাজাবাবার জন্য একটু কষ্ট করেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে আছে আমি না হয় খাজাবাবার জন্য একটু কষ্ট করলাম। কিন্তু হাসপাতালের অসুস্থ রোগীরা কষ্ট করবে কি জন্য? যদি ভালো কোন কাজ খুঁজে না পান তাহলে এখানে গান বাজানো বন্ধ করে ওই হাসপাতালের রোগীর সেবা করেন গিয়ে যান। লোকটা যেন আমার বোকামিতে হতবুদ্ধি হয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
ডাব ওয়ালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন-চারজন আমাকে বলল, থাক আপা আপনি আপনার কাজ কাজে যান।
বুঝলাম ওরা সাঙ্গ-পাঙ্গ। এই কয়েকদিন ওদের আহার-বিহার এই কালেকশনের পয়সাতেই চলছে।
কোন পরিবর্তন নেই। হাই ভল্যুমে গান বাজিয়ে ওদের টাকা ওঠানো (চাঁদাবাজি) চলল আরো দুই/তিন দিন। পরিবর্তনের মধ্যে শুধু এতটুকু গলায় মালা পরানো দুটো গরু দাঁড়িয়ে থেকে পথচারীদের ভূরিভোজের ইঙ্গিত দিতে থাকল।
তৃতীয় দিন অফিস যেতে দেখলাম কালেকশন বন্ধ। মাইক বন্ধ। তবে রোড আইল্যান্ডের একপাশে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে মঞ্চ, … প্যান্ডেল টানানো আর চেয়ার টেবিল পাতার কাজ চলছে।
সন্ধ্যায় মসজিদে মাগরিবের নামাযের হালকা শব্দ শেষ হতেই বেজে উঠলো ওরসের ভয়ংকর ভল্যুমের সাউন্ড। কর্কশ কণ্ঠের একজন ঘোষক নানা ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা মরমী গান বাজল। এরপর আবার মাইকের কণ্ঠ। এবার শুরু হচ্ছে পালাগান। ভাবলাম এরপর হয়তো আধ্যাত্মিক সঙ্গীত শোনা যাবে। কিন্তু না ঘোষকের কণ্ঠের চেয়ে সঙ্গীতসেবীদের কণ্ঠ কোনভাবেই কম কর্কশ না, মমতাজের চটুল গান গাইছে। অস্থির লাগছে এত উচ্চশব্দে।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। পালাগান শেষ হলো।
আবার ঘোষণা…
উপস্থিত সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা এখন আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন ওয়ার্ড কমিশনার বাচ্চু ভাই। বাচ্চু ভাইয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। শুভেচ্ছা স্বাগতম বাচ্চু ভাইয়ের আগমন।
সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা এবারে আপনাদের সামনে তার মূল্যবান বক্তব্য রাখবে আমানুল কবীর বাচ্চু।
আমি প্রচন্ড মাথা ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। আর কতক্ষণ চালাবে এরা? দশটা?… এগারোটা…। তার বেশি নয় নিশ্চয়ই…।
বাসার কেউই কোনও কাজ করতে পারছে না। পায়চারি করছে আর হাসফাঁস করছে, আর ওরস ওয়ালাদের মুন্ডুপাত করছে। লেখাপড়া, পেপার পড়া বা টিভি দেখা প্রয়োজনীয় ফোন কলগুলো অথবা একজন আরেকজনের সাথে গল্প করা কোনটাই এই ভয়ংকর কনসার্টের শব্দের মধ্যে করা সম্ভব নয়।
মাথা ব্যথার একটা পেইন কিরার কেয়ে খাবার টেবিলে বসলাম। শব্দের চোটে খাবারও বিস্বাদ লাগছে। ওহ্ একেই বলে সাউন্ড টর্চার।
লাইট অফ করে দু’কান চেপে শুয়ে পড়লাম। জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ। নাহ… এমন শব্দের মধ্যে কেমন করে ঘুম আসতে পারে?
ঘণ্টাখানেক সঙ্গীত-যুদ্ধের পর আবার কর্কশ কণ্ঠের ঘোষণা…
সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা আমাদের মাঝে এখন উপস্থিত হয়েছেন. . সংগ্রামী জননেতা, মেহনতি মানুষের নয়নের মনি. . কমরেড শমসের চৌধুরী। চৌধুরী ভাইয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। শুভেচ্ছা স্বাগতম…
নাহ্ আর পারা যায় না। ড্রইং রুমে চলে এলাম। এসে দেখি দু ছেলে-মেয়েই তাদের রুম ছেড়ে ড্রইং রুমে এসে কপাল টিপে বসে আছে। আমিও বসে পড়লাম একপাশে। ছেলেটা বলল, আচ্ছা আম্মু আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে রাস্তার দুপাশে মোট ক’টা আপার্টমেন্ট হবে?
আমি মোটামুটি একটা ধারণা করে বললাম ‘তিনশ’র মতো।
ক্লাস টেনে পড়া আমার ছেলের দ্বিতীয় প্রশ্ন, তিনশো এপার্টমেন্টে মোট কতজন লোক থাকে?
আমি আবার একটু হিসেব করে জবাব দিলাম… গড়ে প্রতি এপার্টমেন্টে ছ’জন করে হলে প্রায় আঠারশ’।
‘রাস্তার ওই ওরসে কত লোক আছে জানেন?
‘না আমি যখন বাসায় আসি তখনতো দেখেছি প্যান্ডেলের কাজ চলছে।
মাগরিবের নামায পড়ে বাসায় আসার সময় আমি দেখেছি আড়াই থেকে তিনশ’ মানুষ। এরা সবাই আউটসাইডার। কোন বস্তি থেকে এসেছে। এই এলাকার কেউ না।
‘আমার মনে হয় তুমি ঠিক ধারণা করতে পারনি। এলাকার দু একজন গডফাদারের সম্মতি ছাড়া এখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে এটা ভাবলে কি করে?
ওরা ভোটার ইলেকশনের সময় ভোট দেবে।
তাপরও অনেকগুলো মানুষ একসাথে কিছু বললে গডফাদার হোক আর যেই হোক একটু হলেও শুনত। অন্ত:ত সাউন্ডটাতো কমাতো। অথচ এতগুলো মানুষের মধ্যে কেউ বের হয়ে কিছু বলছেনা, কারো সাথে কারো কোন কন্টাক্টই নেই।
ছেলের কিশোর সুলভ ইতিবাচক চিন্তার সাথে আমি আর দ্বিমত করে কিছু বললাম না। রাত ১টায় আমার মেয়ে উঠে গিয়ে থানায় ফোন করল, অভিযোগ শুনে ডিউটি অফিসার যা বলল, তার সারমর্ম এই, ‘দেখেন আমাদের সামনে দিয়েই মান্নান মাস্টার থানার পারমিশন নিয়ে গেছে। এসব বিষয়ের সাথে পলিটিক্যাল লিডাররা আছে। এলাকাবাসী মিলে যদি কিছূ করতে পারেন তো করেন আমাদের হাত-পা বাধা, কিছুই করার নেই।
শুয়ে, বসে পায়চারি করে রাত তিনটা বাজল। এবার একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান চলছে। অভিনয়, কৌতুক সবই হচ্ছে। রাত চারটার দিকে গিয়ে ওদের ওরস মোবারক সমাপ্ত হলো।
ঘুম থেকে উঠে দেখি সাড়ে এগারোটা। দ্রুত রেডী হয়ে ছুটলাম হোটেল শেরাটনের দিকে। এগারোটা থেকে একটা সেমিনার ছিল। এক ঘণ্টা লেট হয়ে গেল।
বাসায় ফেরার পথে দেখলাম বড় একটা জটলা। লাল সালুর ঘরটা নেই। তবে জটলাটা ওখানেই। আইল্যান্ডের ওপর বসে আছে একজন রোগা পটকা লোক। দুপাশে দুটো বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বেশ ক’জন লোক।
আমার রিক্সা আইল্যান্ড ছাড়িয়ে বাসার গলিতে ঢুকে গেল। রিক্সা থেকে নেমে গেটের দিকে এগুতেই গার্ড সুমন বলল, আপা শুনছেন ওরসের চান্দা উঠাইতো যেই ওস্তাদ হেয় ওই বস্তির রিক্সাওয়ালা বাবুল মিয়ার বউরে নিয়া চইলা গেছে।
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম সিকিউরিটি গার্ড সুমনের দিকে-
‘আপা আমার কথা বিশ্বাস হয় না? বাবুল মিয়া বিকাল থাইকা বাচ্চা দুইডা লইয়া রা¯স্তার উপর বইসা আছে।
– আমি দেখে এসেছি। যোগাযোগ হলো কিভাবে?
– ওরস বাবা বস্তিতে ঘর লইয়া থাকছে এই কয়দিন। আর বাবুল মিয়ার বউ ওর রান্দা-বাড়া কইরা দিত। আর কিছু না বলে আমি লিফটের দিকে পা বাড়ালাম।
আমার চোখ জুড়ে শুধু দুটো শিশু। মাতৃহীন শিশু। লিফটের বাটনগুলোকে মনে হচ্ছে কান্নাভেজা চোখ।
দুটো শিশু কাঁদছে। কাঁদছে ওদের পৃথিবী। মা’টা ফিরে এলে তো ভালই। কিন্তু যদি ফিরে না আসে? তাহলে বাচ্চা দুটোকে সারাজীবনের জন্যে দুঃখের নদীতে সাঁতার কাটতে নামিয়ে দিয়ে গেল।

মন্তব্য ঘর